ফিমেল – ৩৬
ফিমেল
অর্ঘ্য ঘোষ
( ৩৬ )
সকাল সকাল স্নান সেরে নাতিকে স্কুলে পৌঁচ্ছে দিয়ে সরাসরি যাত্রা অফিসে পা রাখে সোহাগী । সেখানে তখন ভজনকাকা , মদনদা, বৃন্দারা সব তারই অপেক্ষায় বসে রয়েছে। ঘরের কোনে গ্যাসে চায়ের জল চাপিয়েছে বৃন্দা। শুরু হয় পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা। ভজনকাকা হতাশ গলায় বলেন , বি,ডি,ও’ই আমাদের কথা কানে তুললেন, তখন আর কেই বা আমাদের কথা শুনবে ?
জবাবে সোহাগী বলে, বি,ডি,ও আমাদের কথা কানে নেন নি ঠিকই , কিন্তু তাতে হতাশ হলে চলবে না। কারণ বি, ডি,ও’ই তো প্রশাসনের শেষ কথা নয়। আমাদের অন্য কিছু ভাবতে হবে।
চা পরিবেশন করতে করতে বৃন্দা প্রশ্ন তোলে — এরপর তাহলে আমরা কি করব ? সোহাগী জানত এই প্রশ্নটার মুখোমুখি তাকে দাঁড়াতেই হবে। তাই রাতেই সে ভেবে রেখেছিল তাদের পরবর্তী কর্মপন্থা। সবিস্তারে তাইই সে তুলে ধরে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই সে বলে , আমরা আমাদের সমস্যার কথা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে লিখে পাঠাব। তারপর যাব ডি,এম এবং শাসকদলের নেতাদের কাছে। তাতেও কিছু কাজ না হলে তখন অন্যরকম ভাবতে হবে।
— অন্যরকমটা কি শুনি ? জানতে চান মদনদা।
সোহাগী বলে , প্রশাসনের চেয়ারে যে যখন বসে থাকে সে বি,ডি,ও’ ই বলুন আর ওসি”ই বলুন সাধারণ মানুষকে তো তারা গরু ছাগলের চেয়ে বেশি কিছু ভাবে না। তাই প্রশাসনকেই মাঠে ময়দানে টেনে আনতে হবে।
— প্রশাসনকে মাঠে ময়দানে টেনে আনা মা ? প্রশ্ন তোলেন ভজনকাকা।
— সেবারে দেখলেন না ষষ্ঠীনগর মোড়ে ছাগল চাপা পড়ায় পাড়ার ছেলেরা ক্ষতিপূরণের দাবিতে পথ অবরোধ করেছিল। বাস ট্রাক সব আটকে পড়েছিল। খবর পেয়েই ছুটে এসেছিলেন ওসি, বি,ডিও।
মাঝপথেই ভজনকাকা বলে ওঠেন , হ্যা হ্যা মনে আছে অবরোধ তুলতে ছেলেগুলোকে কি মিষ্টি মিষ্টি করে বোঝাচ্ছিলেন ওরা। শেষে ক্ষতিপূরণের টাকার ব্যবস্থা করে সমাধান হয়। সোহাগী বলে , তবে হ্যা আমরা অন্যদের অসুবিধায় ফেলে পথ অবরোধ করব না। ওরা যদি আমাদের ঘর ভাঙতে আসে আমরা ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঘরেই বসে থাকব। আমরা তো না মরে বেচে আছি , নাহয় সরকারের বুলড্রোজারে পুরোপুরি মারা পড়ব।
— কিন্তু দিদি, আমরা তো মাত্র তিরিশ জন। পুলিশ আমাদের মেরে তুলে দেবে না তো ? সংশয় প্রকাশ করে বৃন্দে। সোহাগী বলে , খুব ভালো প্রশ্ন। অল্প সংখ্যক লোক হলে প্রশাসন কোন গুরুত্বই দেবে না। দেখলে ছাগল মরার সময় পথ অবরোধে পাড়ার ছেলেরা কেমন এককাট্টা হয়ে উঠেছিল। আমাদেরও ওই রকম জমায়েতের চেষ্টা করতে হবে।
— কিন্তু দিদি ছাগল মরার পথ অবরোধের সময় ক্ষতিপূরণের টাকায় না হয় ফিস্ট খাওয়ার ব্যাপার ছিল , কিন্তু আমাদের তো তা নয়। আমরা কাউকে কিছুই দিতে পারব না। তাহলে শুধু শুধু কে আসবে আমাদের সঙ্গে ? আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে সোহাগী বলে , আসবে আসবে। আমাদের মতো আরও অনেকের বাড়ি ভাঙা পড়বে। তাদের হয়তো আমাদের মতো এত খারাপ অবস্থা নয় , কিন্তু স্বেচ্ছায় কেউ নিজের খড়ের কুটোটি পর্যন্ত প্রাণে ধরে অন্যকে দিতে পারে না। সেখানে একটু চেষ্টা করে বাড়ি ভাঙার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইবেনা কেউ। আমাদের ওইসব মানুষকেও সামিল করার চেষ্টা করতে হবে। তাহলে অনেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাদের পাশে দাঁড়াবেন বলেই আমার মনে হয়।
কথাটা মনোপুত হয় সবার। সবাই একযোগে বলে ওঠে, কথাটা ফেলে দেওয়ার নয়। আমাদের সবরকম চেষ্টাই করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় কাজ। কয়েকজন বেড়িয়ে পড়ে যাদের বাড়ি ভাঙার আশঙ্কা রয়েছে তাদের সঙ্গে কথা বলতে। কয়েকজন ব্যস্ত হয়ে পড়ে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি পাঠানোর কাজে। প্রশাসনের পাঠানো ঘর ছাড়ার নোটিশের সময়সীমা যত কমে আসে যাত্রাপাড়ার লোকগুলোর উদ্দামতা তত বাড়ে। মরীয়া হয়ে ওঠে তারা। সোহাগী চোখে মুখে ফুটে ওঠে চ্যালেঞ্জের ছাপ। সবখানেই তো ভগবান তাকে হারিয়ে দিয়েছে। এই লড়াইটা তাকে জিততেই হবে। মনে মনে শপথ নেয় সে। পরদিনই সদলবলে গাড়ি ভাড়া করে
ডি,এম অফিসে যায় তারা। কিন্তু যাওয়াটাই সার হয়। দেখা করার অনুমতিই মেলে না। লিখিত আবেদন পত্রটাই কেবল জমা দেওয়া হয় মাত্র। ডিএম অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে সবার চোখে মুখে কেমন যেন হতাশার ছাপ ফুটে উঠতে দেখে সোহাগী। ভজনকাকা তো বলেই বসে, বি,ডি,ও কথা কানে তুললেন না। ডি,এম দেখাই করলেন না। আর বোধহয় আমাদের উঠে যাওয়া ছাড়া কোন উপায়।
ভজনকাকার কথা প্রমাদ গোনে সোহাগী। হতাশা বড় সংক্রামক রোগ। সবাই সংক্রামিত হয়ে পড়লে তাদের আন্দোলনটা মাঝমাঠে মারা যাবে। তাই সবার মনোবল ফেরানোর জন্য সে বলে , প্রশাসনিক আধিকারিকদের কাছে আমরা সাড়া পায় নি বলে মাঝপথে হাল ছেড়ে দিলেই চলবে ?
—- আর কি’ই বা করার আছে আমাদের ?
—- কেন আমরা শাসকদলের নেতাদের কাছে যাব। তারপর রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানানোর ব্যাপারটাও তো আছে ।
কথাটা ভজনকাকার খুব একটা মনোপুত হয় না। উদাসীন সুরে বলেন , সে যে লম্বা পথ। ঘরের দোরগোড়াতেই যেখানে হোঁচট খেলাম , সেখানে অত দুরের পথ যাব কি করে ?
এই আশঙ্কাটাই করছিল সোহাগী। একবার হতাশা বোধ মনের মধ্যে বাসা বাঁধতে পারলেই মনোবলটাই হারিয়ে যাবে। ভেবে পায় না এতগুলো মানুষের মনোবল ফেরাতে কি করবে এখন সে ? তাকে কিছু করতে হয় না। এবার মদনদাই আসরে নামেন। দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন , যা হবার তা তো হবেই। নেমেছি যখন তখন এর শেষ না দেখে ছাড়ব না।
ম্যাজিকের মতো মদনদার কথায়। মুহুর্তের মধ্যে সবাই যেন হারিয়ে যাওয়া মনোবল ফিরে পেয়ে বলে ওঠে , ঠিক কথা। শেষ পর্যন্ত কি হয় দেখাই যাক।
ভজনকাকাও আর দ্বিরুক্তি করেন না। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচে সোহাগী। ঠিক হয় পরদিন শাসক দলের স্থানীয় নেতা আব্দুল হান্নানের কাছে যাওয়া হবে। তার কাছে যেতে খুব একটা মন ছিল না সোহাগের। সে চেয়েছিল বাঁকুদাকে গিয়ে তাদের সমস্যার কথা বলবে। ভালোমানুষ হিসাবে পরিচিতি বাকুদার। কিন্তু তার নাম শুনে এক কথায় না করে দেন ভজনকাকারা। ভালোমানুষ হলেও বাঁকুদার নাকি দলে কোন গুরুত্বই নেই। হালে দলবদলে শাসকদলে নাম লিখিয়ে নেতা হয়ে বসেছেন হান্নান। পুরোন দলে থাকার সময় সমবায়ের লক্ষ লক্ষ টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে। এখনও প্রভাব খাটিয়ে নামে -বেনামে সরকারি, বেসরকারি জমি জলের দামে কিনে মোটা টাকায় বিক্রির ব্যবসা ফেঁদেছেন। ওই রকম লোক অন্যের জন্য ভালো কিছু করবে বলে মনে হয় না সোহাগীর। কিন্তু হান্নানই এখন শাসক দলের মাথা। এলাকার সর্বেসর্বা। তাকে বাদ দিয়ে এলাকার কোন কাজ হওয়ার যো নেই। অগত্যা ঘাড় পাততে হয় সোহাগীকে। কথায় আছে তোমার পায়ে পড়ি , না কাজের পায়ে পড়ি। ভজনকাকারাও তাকে বোঝান , ওই ভুলটি করলে হবে না। পরে দোষ পেতে হবে। কিছু হলে তখন হান্নানই বলার সুযোগ পাবে, কই আমাদের তো কিছু বলো নি। তাছাড়া ভোটের আগে এসে ওরা নিজে থেকেই তো মিষ্টি মিষ্টি করে বলে যায়। কোন কিছু সমস্যা হলে ওদের জানাতে বলে। দেখিই না আমাদের কথা শুনে ওরা কি বলে ? অগ্যতা পরদিন সবাই হান্নানের বাড়িতে যায়। লিখিত দরখাস্তটা দেখে হান্নান বলেন , সবই তো বুঝলাম। কিন্তু পার্টির কাছে কিছু সাহায্য নিতে হলে পার্টিও তো কিছু প্রতিদান চাইবে। তোমারা পার্টির মিটিং মিছিলে এসো। বিধানসভার ভোটটা পেরিয়ে যাক। তারপর তোমাদের জন্য কি করা যায় দেখছি। ততদিন তোমাদের ঘর যাতে না ভাঙে দেখব।হান্নানের কথা শুনে যাত্রাপাড়ার মানুষগুলোর ধরে যেন প্রাণ ফিরে আসে। বিধানসভা ভোটের মাস খানেক দেরী রয়েছে। তার মানে মাস খানেক কোন চিন্তা নেই। আর আশ্চর্যজনক ভাবে সোহাগীরা লক্ষ্য করে তাদের বাড়ি ভাঙার যাবতীয় প্রশাসনিক তৎপরতা রাতারাতি উধাও হয়ে গিয়েছে। এজন্য হান্নানকে মনে মনে সাধুবাদই জানায় তারা। কিন্তু হান্নানের শর্তটা তাদের কিছুটা দোটনায় ফেলে। সম্মান থাক বা নাই থাক সোহাগীরা নিজেদের শিল্পীই মনে করে। সেই হিসাবে তাদের কাছে সব পক্ষের লোকই আসেন। সরাসরি কোনও রাজনৈতিক দলের মিটিং-মিছিলে গেলে অন্যপক্ষের মনে কি প্রতিক্রিয়া হবে তা নিয়েই দোটানা শুরু হয় ওদের। ভজনকাকা অবশ্য মনকে প্রবোধ দেওয়ার মতো করে বলেন , তত ভাবলে চলবে না। আমাদের শিয়রে সংক্রান্তি। কথায় আছে , যেমন কলি তেমন চলি। কত বড়ো বড়ো লোক রাতারাতি রঙ বদলে ফেললেন আর আমরা চুনোপুঁটি বই তো নয়। বাকিরাও ভজনকাকাকেই সমর্থন করে। সোহাগীও আর না করতে পারে না। হান্নানের কাজকর্ম মন থেকে মানতে পারুক বা নাই পারুক অন্যদের মঙ্গলের কথা তাকে ভাবতেই হয়। কারণ সবাই যে তাকেই ভরসা করে। অগত্যা হান্নানদের মিটিং মিছিলে পা মেলাতে দেখা যায় যাত্রারপাড়ার লোকেদের।
শুধু তাই নয় , প্রচারের শেষদিনে হাটতলায় তারা রাজ্যস্তরের নেতা মন্ত্রীদের সামনে শাসকদলের সাফল্যের উপর নাটক লিখে পরিবেশনও করে। শুনে ওইসব নেতা — মন্ত্রীরাও হাততালি দিয়ে প্রশংসা করেন। ওই মিটিং-এ নেতা মন্ত্রীরা তাদের ভাষণে উন্নয়ণের বন্যা বইয়ে দেন। ফের ক্ষমতায় এলে রাম রাজত্ব প্রতিষ্ঠার মতোও সব কথা বলেন। ঘন্টার পর ঘন্টা ঠায় রোদে বসে ওইসব ভাষণ শুনতে শুনতেই কেমন যেন ঘোর লেগে যায় সোহাগীদের। তারা মনে মনে ভাবে , যারা এতকিছু পারে তারা তাদের জন্য মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই আর মোটা ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা করতে পারবেন না তাই কখনও হয় ? ঘোরটা অবশ্য কেটে যায় ভোটের পর।
( ক্রমশ )